আমি নিতান্তই সাধারণ একজন ফ্রিলান্সার। প্রায় ৭ বছর ধরে আছি ফ্রিলান্সিং এর সাথে। এই দীর্ঘ সময়ে অনেক চড়াই উতরাই এর মধ্যে দিয়ে গিয়েছি। অনেক নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি।
এই সামান্য কষ্টের অবদান স্বরূপ ছোট ছোট কিছু স্বীকৃতিও পেয়েছি অবশ্য। ২০১৪ সালে Basis Outsourcing Award তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। (যদিও এই এওয়ার্ড টা নিয়ে অনেকের মধ্যেই কিঞ্চিৎ অ্যালার্জি আছে, যতোটুকু জানি )Upwork এর বর্তমানে প্রচলিত Top Rated ব্যাজ টাও বোধহয় উল্লেখ করার মত।
আমার ফ্রিলান্সিং জার্নির শুরুটা শেয়ার করছি। ভালো লাগবে যদি একজনও কিছুটা অনুপ্রেরণা অথবা গাইডলাইন পান।
আমার শুরু ২০১১ সালে। একটা জাতীয় দৈনিক পত্রিকার রিপোর্ট থেকে যেটা আব্বু আমাকে দেখানর জন্যে নিয়ে এসেছিল কোথা থেকে যেন।
আউটসোরসিং করে নাকি ঘরে বসে টাকা ইনকাম করা যায়, এটা ছিল রিপোর্টের মুল বক্তব্য। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়) দ্বিতীয় বর্ষে পরছি। এই সময়ে নিজে ভালভাবে চলার জন্যে কিছু টাকার সোর্স খুব ই দরকার হয়। অনেকেই টিউশনি করায়। কিন্তু আমার সেটা ভালো লাগতো না, আমি পারতাম ও না তেমন কিছু, যে পড়াব।
রিপোর্ট দেখে আগ্রহ হল। সারাদিন ফেইসবুকে বসে থাকি, তার থেকে কিছু সময় এখানে দিলেও যদি মাসে ৫-৭ হাজার টাকা উপার্জন করা যায়, তাই বা কম কি! শুরু করলাম খোজ খবর নেয়া। ঝোঁকের বসে একাউন্ট করে বসলাম Odesk (তৎকালীন) এ, এরপর প্রোফাইল গোছান শুরু করলাম। অথচ আমি কোন কাজ ই জানি না। কিছুই বুঝতাম না, তাই আওারলি রেইট দিয়ে রাখলাম ১৫/২০ এর মত!
আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ( জাহাঙ্গীরনগর ) ২ জন বন্ধু ফ্রিলান্সিং করতো। ওদের সাহায্য চাইলাম। ওরা কিছুটা আইডিয়া দিলো। আমার সবচেয়ে বড় এবং প্রথম প্রশ্ন ছিল বিদেশ থেকে কি আসলেই এদেশে ডলার আনা সম্ভব? আমার বিষাস করতেই কষ্ট হচ্ছিল। কিছুটা সন্দিহান ছিলাম।
আরো পড়ুনঃ- এক অনন্য অনুপ্রেরনার গল্প
ওরা বলল, ডলার আনার চিন্তা পরে করো, আগে কাজ শেখ এবং শুরু করো। তবুও আমি ঠিক আস্থা পাচ্ছিলাম না, একটু কনফিউসড ছিলাম, এগুলো ফেইক কিনা সে বিষয়ে।
প্রোফাইল করতে গিয়ে গলদঘর্ম হতে হল। কিছু বুঝি না, কিছুই পারি না কি করবো। সপ্তাহ খানেক চেষ্টা করে রণে ভঙ্গ দিলাম। ফ্রিলান্সিং করার স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিলাম।
৩-৪ মাস পরে হঠাত কি মনে করে আবার ওদের সাথে কথা বললাম। টিভি, পত্রিকাতে দেখলাম কিছু রিপোর্ট এ ব্যাপারে।
এবার কেন যেন কিছুটা আশ্বস্ত হলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম চেষ্টা করবো আবার। নিজেকে নিজেই বোঝালাম “এবার ফ্রিলান্সিং এর শেষ দেখেই ছাড়বো”। কোনভাবেই ক্ষান্ত দেব না। তখন থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত হাল ছাড়ি নি, আলহামদুলিল্লাহ্। পেছন ফিরে তাকাতে হয় নি।
দ্বিতীয় বারের চেষ্টায় এবং বন্ধুদের সহায়তায় মোটামোটি একটা প্রোফাইল দাড় করালাম। এবার স্কিল ডেভেলপ করার পালা। (যদিও আমি রিকমেন্ড করবো আগে স্কিল ডেভেলপ করে, পরে প্রোফাইল তৈরি করতে)। আমি যা পারি, তা হচ্ছে টুকটাক ইংরেজি। কয়েকজনের সাথে কথা বলে বুঝলাম “Article Writing and Blogging” ই আমার জন্যে শুরুতে ভালো কাজের ক্ষেত্র হতে পারে।
প্রোফাইল তৈরি করে জব এ এপ্লাই করা শুরু করলাম। (আমি বিড শব্দটার পরিবর্তে “এপ্লাই” বলতে বেশী স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। বিড টা বোধহয় কোন কিছু কেনার জন্যে দর হাঁকাহাঁকির ক্ষেত্রেই বেশী প্রযোজ্য) । সবার কাছে শুনলাম প্রথম জব টা পাওয়াই সবচেয়ে কঠিন। আসলেই কঠিন ছিল। অনেক গুলো জব এ আপ্লাই করে, প্রায় এক মাস অপেক্ষার পর প্রথম জব টা পেলাম।ছোট জব, মাত্র ৫ ডলার এর।
একটা আর্টিকেল লিখতে হবে “top 10 worth nuclear disasters in the world” এর উপরে। জব টা পেয়ে যে কতটা আনন্দ লাগলো, সেটা ভাষায় প্রকাশ করার মত না। শুরু থেকে আব্বু আম্মু কে বলে আসছি আমি ইন্টারনেটে কাজ করে টাকা ইনকাম করবো। তারা খুব একটা ভরসা পায় নি আমার কথায়। স্বাভাবিক ভাবেই ফেইক মনে করেছিল। তাই ওনাদের প্রমাণ করার জন্যে একটা কাজ পাওয়া এবং সেটা থেকে টাকা উপার্জন করে দেখানটা খুবই জরুরী ছিল। যদিও কাজ পাওয়ার পরেও তাদের পূর্ণ বিষাস অর্জন করতে পারি নি যতক্ষণ না আমার একাউন্টে টাকাটা ওঠাতে পেরেছি। তাই প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ভালো ভাবে কাজ টা করার জন্যে পড়াশোনা শুরু করলাম।
কাজের শুরুতেই প্রথম nuclear disaster হিসেবে টাস্কটাকেই মনে হতে লাগলো। অনেক খেটেখুটে সেই disaster পাড় করে বিভিন্ন জায়গা থেকে কপি পেস্ট করে প্রথম কাজটা জমা দিলাম।
খুব আশায় ছিলাম, এত কষ্ট করে কপি পেস্ট(!) করে করেছি, নিশ্চয়ই ক্লায়েন্ট খুব খুশি হবে। কাজ জমার দেয়ার পর পরেই ক্লায়েন্ট এর ক্ষুব্ধ রিপ্লাই।
“এ কি করেছো, এভাবে কপি পেস্ট করে করলে হবে না। নিজের ভাষায় লিখতে হবে। তুমি না পারলে বল, আমি অন্য কাউকে দিয়ে করিয়ে নেব। ”
আমি খবু ডেস্পারেট। অনুনয় বিনয় করে বলে আবার কাজটা নিলাম।
তবে একটা ব্যাপারে আমি খুব ই চমৎকৃত হয়েছিলাম। আমি যে কপি করেছি সেটা এই ব্যাটা কেমনে বুঝলো? Copyspace এর সাথে তখন ও আমার পরিচয় হয় নি। এর পরে আবার পড়াশোনা করে জানলাম কপি করে লিখলেই ধরে ফেলবে, এরকম অনেক সফটওয়ার আছে। মনে মনে সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ারদের এক প্রস্থ গালি-গালাজ করে আবার কাজে নেমে পরলাম।
এবার লিখলাম নিজের ভাষাতেই। সাবমিট করলাম। ক্লায়েন্ট নিয়ে নিলো, তবে খুব একটা খুশি হল না। মোটামোটী একটা ফিডব্যাক দিয়ে পেমেন্ট রিলিজ করে দিলো। মজার বিষয় হচ্ছে এখন আমি সে ফিডব্যাক রিমুভ করার ক্ষমতা রাখি
আমি বিষাস ই করতে পারছিলাম না যে আমার একাউন্টে ডলার এসেছে। বেশ ভালো লাগছিল। আমার বাবা মাকে আশ্বস্ত করলেও, আমি নিজেও কিন্তু কিছুটা সন্দিহান ছিলাম এই টাকা কি আসলেই তুলতে পারবো কিনা!
সবার নাকি প্রথম জবটা পেতে সবচেয়ে বেশী সময় লাগে। আমার লাগলো দ্বিতীয়টায়। সবুর এর ফল মিষ্টি হয়। প্রায় দুই মাস পরে আমার দ্বিতীয় জব টা পেলাম। কন্ট্রাক্ট এমাউন্ট ছিল ২০ ডলার। “Creative Writting” .
লিখলাম নিজের ইচ্ছে মত। সাবমিট করলাম। ক্লায়েন্ট এর খবর নাই, দিন যায়, সপ্তাহ যায়, নো সারা শব্দ। সন্দেহ দানা বাধতে শুরু করলো। আসলেই কি এগুলো সত্যি না ফেইক? বাবা মার সন্দেহ ভুল প্রমাণ করতে পারবো তো?
অবশেষে ভদ্রমহিলা আসলেন। ২০ ডলার এর জায়গায় ১০ ডলার বোনাস সহ ৩০ ডলার নিয়ে, যে কাজটা ওনার এতই পছন্দ হয়েছে। সাথে দুর্দান্ত ফিডব্যাক। আমার আনন্দ দেখে কে? এখন শুধু টাকা ওঠানোর পালা। আমি অলরেডি ব্যাঙ্ক এ স্টুডেন্ট একাউন্ট করে রেখেছি।
এরপরে আর আর্টিকেল রাইটিং এর কাজ পেতে সমস্যা হয় নি। কাজ করে যেতে থাকলাম। ১২০ ডলার এর মত জমার পরেই সকল সন্দেহের কফিনে শেষ পেরেক ঠোকার জন্যেই পেমেন্ট ওঠানর সিদ্ধান্ত নিলাম। প্রথম টাকা ওঠানোর দিনটাও একটা স্পেশাল দিন। উত্তেজনায় ভরপুর। অবশেষে টাকা ওঠাতে সমর্থ হলাম, Moneybookers (বর্তমানে Skrill) এর মাধ্যমে।
বেশ কিছুদিন কাজ করার পরে স্কিল ডেভেলপ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম। ৮-১০ হাজার টাকা তো উপার্জন করা যায় এটুকু কাজ করলেই। আমার ফ্রেন্ড Web Design এর কাজ করছে। সে ৫০-৭০ হাজার টাকা উপার্জন করে মাসে। প্রথম টার্গেট সম্পন্ন হয়েছে। এবার পরবর্তী টার্গেট এর উদ্দেশে ছোটার পালা।
স্কিল সুইচ করার জন্যে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। এ কষ্টের জার্নি ও হয়তো শেয়ার করবো অন্য কোনদিন। অবশ্য যদি আমার এই লেখাটা আপনাদের বিরক্তির কারণ না হয়ে দাঁড়ায়।
আজ এ পর্যন্তই। বেশ বড় বড় হয়ে গেছে লেখাটা। কষ্ট করে, ধৈর্য নিয়ে পড়ার জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ।
আমি এখন UK র WordPress based একটা কোম্পানি OptimizePress এ রিমোটলি জব করছি।
আমার প্রথম রিমোট জব ছিল ThemeFusion এ, যাদের বানানো Avada থিমটি বহু বছর ধরে Themeforest এর এক নাম্বার থিম এর জায়গা নিয়ে রেখেছে।
যদিও উপদেশ দেয়ার জন্যে আমি খুব ই সামান্য একজন মানুষ, তাও ছোট্ট একটা উপদেশঃ
যেটা শুরু করেছেন সেটার শেষ দেখে ছাড়বেন, হাল ছাড়বেন না।
Post a Comment